স্টাফ রিপোর্টার: দেখতে দেখতে আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় দফার মেয়াদও ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন সরকার টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন রয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তোড়জোড়। চলছে নানা ধরণের বাকবিতণ্ডা। নির্বাচন কমিশন নতুন করে গঠন নিয়েও চলছে নানা প্রস্তুতি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন সংক্রান্ত ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপও করছেন। ক্যালেন্ডারে সদ্য পা ফেলা ২০২২ সাল হলো জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির বছর। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর। এ নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং অন্যতম প্রধান দল বিএনপি নিজ নিজ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় আসতে চায় আবারও, এবং চরমভাবে কোণঠাসায় পড়া বিএনপি তার পুরনো প্রতাপ ফিরে পেতে চায় আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা অধিগ্রহণের মাধ্যমে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সামনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়াই নতুন বছরে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এ বছর দলের তৃণমূলের কোন্দল নিরসন ও সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর দিকে আওয়ামী লীগ বেশি গুরুত্ব দেবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ঠিক এমনটাই মনে করছেন। তাঁদের মতে, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন পরীক্ষা হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে তাদের উদ্যোগী হতে হবে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নেও কাজ করতে হবে সরকারকে।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর সম্মেলন করার কথা। সে হিসাবে এ বছরে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, বিগত দুই বছরে অল্পসংখ্যক উপজেলা কমিটির সম্মেলন হয়েছে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের প্রায় ৬৫০টি উপজেলা, থানা ও পৌরসভা কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে জাতীয় সম্মেলনের আগে ১৩৮টির সম্মেলন হয়। গত দুই বছরে ৫০টি কমিটির সম্মেলন হয়েছে। এখনো ৪৫০টি কমিটি মেয়াদ উত্তীর্ণ। এর মধ্যে অন্তত ৬২টির সম্মেলন হয়েছে ১৫ থেকে ২৫ বছর আগে। ছয় থেকে ১৪ বছর আগে সম্মেলন হয়েছিল অন্তত ১৬৫টি উপজেলা, থানা ও পৌরসভার।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা যায়, নতুন বছরে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি, বিদ্যমান বিরোধ নিরসন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ইউনিটগুলোর কাউন্সিল ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন এবং দলকে আরো জনসম্পৃক্ত করতে মাঠে নামবে দলীয় নেতৃবৃন্দ।
তবে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা চাপ সামাল দেওয়া সরকারের জন্য বরাবরই বড় চ্যালেঞ্জ। এ বছর সরকার ও আওয়ামী লীগকে জনগণের মন জয়ে মনোযোগী হতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে বিএনপিও। নির্বাচনকেন্দ্রিক জরিপ, প্রার্থী যাচাই-বাছাই, সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনাÑসবই ঠিক করা হবে ২০২২ সালে।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে বছরের শুরু থেকে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করবে দলটি। অঙ্গসংগঠনগুলোতে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসবে। জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণের চিন্তা-ভাবনাও আছে। অনেকদিন পর ঢাকার বাইরে বেশ কিছু সমাবেশ করতে পেরেছে বিএনপি। তাতে লোকসমাগম দেখে স্বস্তি পাচ্ছেন নেতারা।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, র্যাব ও এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়েছে। নির্বাচনের আগে এই চাপ আরো বাড়বে। চাপ অব্যাহত থাকলে দেশে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি হতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এমনও ধারণা তৈরি হয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কিংবা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো একপক্ষীয় নির্বাচন আর হবে না। যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ তৈরি করেছে, তা অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে। ফলে অন্যান্য দেশও আগামী নির্বাচন সচ্চ ও গ্রহণযোগ্য হতে চাপ প্রয়োগ করবে।
পুরনো নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ১৫ ফেব্রুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন হবে। রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে ইসি গঠন হবে, তাতে বিএনপি ভালো কিছু দেখছে না। বিএনপির মতে, অতীতের মতো ‘আজ্ঞাবহ’ নির্বাচন কমিশন হতে যাচ্ছে। এই ইস্যুতে বিএনপি আন্দোলনে থাকবে বলে জানা গেছে। খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠাতে চলমান আন্দোলনও চলবে। নতুন বছরের শেষের দিকে নির্দলীয় সরকারের দাবিতেও তারা আন্দোলনে নামবেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নতুন বছরে বিএনপি ব্যতিক্রমী কিছু কর্মসূচি গ্রহণের চিন্তাভাবনা করছে। ঢাকায় মহাসমাবেশের পাশাপাশি লং মার্চ, ট্রেন মার্চ, স্বেচ্ছা কারাবরণসহ কিছু কমর্সূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। তবে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টি এখন তাঁদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে সহানুভূতির পাশাপাশি সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও বিরক্তি বাড়ছে। জনগণের এই সহানুভূতি কাজে লাগাতে চান তাঁরা।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা এ নিয়েও দোলাচলে আছে বিএনপি, এবং একইসাথে তাঁদের সাথে দুলছে গোটা দেশের মানুষ। সাধারণ মানুষও নিশ্চিত নয় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা। এ বিষয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ভাষ্য, ‘নির্বাচনে যাব কী যাব না, তা রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে। নির্দলীয় সরকার হলে সিদ্ধান্ত বদল হবে। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি রাখতে হয়। যেহেতু ২০২২ সাল নির্বাচনের আগের বছর, তাই বেশির ভাগ প্রস্তুতি এ বছরই নিতে হবে। সবই রাজপথ দখলে রেখে করা হবে।’