ভিবি নিউজ ডেস্কঃ
কোনো পণ্য বা সেবা যিনি ভোগ করেন বা ভোগের উদ্দেশ্যে ক্রয় করেন তিনিই ভোক্তা। একটা সাধারণ আলপিন থেকে শুরু করে বাড়ি-গাড়ি-ইন্টারনেট-ঔষধ প্রত্যেকটি জিনিষ আমাদের কোনো না কোনো ভোগে আসে। ভোগের এ প্রত্যেকটা বস্তু হওয়া চাই নিরাপদ ও নির্ভেজাল। ঝং ধরা আলপিন যেমন আমাদের নিরাপত্তার পরিবর্তে জীবনের জন্য ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে তেমনি মানহীন উপকরণ দিয়ে আলিশান বাড়ি তৈরি করলেও সে বাড়িতে বাস আর মৃত্যুর সাথে বসবাস এক হয়ে দাঁড়ায়। খুব দামি গাড়ি কিন্তু ব্রেক কাজ করেনা, জেনেশুনে এমন গাড়িতে কেউ উঠবেনা। একইভাবে মানহীন ল্যাবরেটরিতে জেনেশুনে কেউ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাবেনা। প্রত্যেক ভোক্তাই তার জীবন ও কাজের নিরাপত্তার জন্য যথোপযুক্ত ও নিরাপদ পণ্য বা সেবা প্রাপ্তির অধিকার চায়।
জীবনের নিরাপত্তা কিংবা কাজের নিরাপত্তার জন্য ভোক্তার অধিকার রয়েছে প্রতিশ্র“ত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে পাওয়ার। সে পণ্য বা সেবা সঠিক মানে, সঠিক মাপে পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। পণ্য বা সেবার নির্ধারিত মূল্য বা বিনিময়ে সে পণ্য বা সেবা পাওয়া ভোক্তার অধিকার। তাই পণ্যের উপাদান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, বিক্রয়মূল্য, কার্যকারিতা জানার অধিকারও তার রয়েছে। এর যেকোনোটির ব্যত্যয় ঘটলে সে পণ্য বা সেবাদানকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার অধিকার তিনি সহজাতভাবেই ভোগ করবেন। সর্বোপরি কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়াও ভোক্তার একান্ত অধিকার।
আমরা সবাই কোনো না কোনো পণ্য বা সেবার ভোক্তা বা গ্রহীতা। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন করেছে ২০০৯ সালে। আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করা এমনকি বিক্রয়ের প্রস্তাব করা অপরাধ। জেনেশুনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন ভেজাল মিশ্রিত অথবা নকল পণ্য, সেবা অথবা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা একটা বড় অপরাধ। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ জীবনের জন্য কত ক্ষতিকর তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। এসিড বিক্রেতা মনের হরষে এসিড বিক্রি করছে আইনের তোয়াক্কা না করে। কিন্তু যদি এমন হয়-কখনও নিজের বাসা থেকে টেলিফোন আসে কোনো এক সন্ত্রাসী তার মেয়েকেই এসিড মেরেছে এবং একটু পরে যখন আরও বুঝতে পারে যে সেই সন্ত্রাসী তার দোকান থেকেই এসিড কিনেছিল তখন সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে যে সে কী ভুল করেছিল।
ওজনে কারচুপি, ওজন যন্ত্রে কারচুপি, পরিমাপে বা পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপির বচসা আমরা প্রায়ই হাট-বাজারে দেখে থাকি। কিন্তু কারচুপিকারী ব্যবসায়ীরা যখন ভোক্তা হিসেবে অন্য কোনো পণ্য কিনতে গিয়ে এ কারচুপির শিকার হয় তখন বেচারার খুব মন খারাপ হয়। আবার মন খারাপ না ও হতে পারে যদি সে উপলব্ধি করে যে সেও তো ওজনে কারচুপি করে। কিন্তু আম-জনতার মন খারাপ হবেই। আর এ কারচুপির কারণে আজ সৎ ব্যবসায়ীদের অবস্থা সংকটাপন্ন। তারা এসব কারচুপিকারীদের সাথে মূল্য প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেনা। পণ্যের গায়ে পণ্যের উপাদান, বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের কার্যকারিতা ইত্যাদি না লিখে পণ্য উৎপাদকরা ভোক্তাকে ঠকাচ্ছে প্রতিনিয়ত যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রতিশ্র“ত পণ্য বা সেবা প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী সঠিকভাবে না দেয়া ভোক্তার অধিকার ক্ষুণেœর আরেকটি অপরাধ। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় প্রতিশ্র“ত সেবা প্রদানে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক সেবা না দেয়ার কারণে প্রায়ই জীবনহানি ঘটছে। জীবনহানির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিক্রিয়া দেখালে বা সুবিচার চাইলে এসব অসাধু সেবাদাতারা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করছে বা সামগ্রিকভাবে অন্য সেবা গ্রহীতাদের সেবাদানে বয়কট করছে। এটা আইন মান্য নাকরা এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের
জাতীয় দীনতা, নিচতার বহিঃপ্রকাশ বৈকি। যে অপরাধের জন্য তার লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল, তা না করে সে উদ্ধতপনা করছে, আস্ফালন করছে, হুমকি দিচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন ধরনের শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় সে দ্বিগুণ হারে অপরাধ করছে। এ সবই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ৷
এক তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচ কোটি লোক খাদ্য বিষক্রিয়ায় ভুগছে। রাজধানী ঢাকার ষাট ভাগ সবজিতেই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশানো থাকে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ৭৬টি খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে যার চার ভাগের তিন ভাগ নমুনায় ভেজাল পায়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ কোম্পানি ২৪৬টি, আয়ুর্বেদিক কোম্পানি ২২৪টি, ইউনানি কোম্পানি ২৯৫টি, হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠান ৭৭টি সহ মোট ৮৪২টি ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট তৈরি করছে ১০৬টি প্রতিষ্ঠান। ৪০ থেকে ৫০টি ব্যতীত বাকি কোম্পানিগুলো নকল, ভেজাল ও ন্নিমানের ঔষধ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন নকল ও ভেজাল ঔষধের অনেকগুলোর মধ্যে কোনো কেমিকেল উপাদান নেই। ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব ঔষধ।
এসব অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, কারচুপি, মানহীনতা প্রতিরোধে একাধিক আইন রয়েছে। সর্বশেষ সরকার ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন করেছে। আলোচিত প্রত্যেকটি অপরাধের জন্য এ আইনে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, জেল-জরিমানা করাও হচ্ছে।
অপরাধের তুলনায় জেল-জরিমানা করা হয় অতি নগণ্য। আবার এটাও ঠিক যে অনেক খুচরা ব্যবসায়ী জানেও না যে, পণ্যের গায়ে পণ্যের উপাদান, বিক্রয় মূল্য, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের কার্যকারিতা ইত্যাদি লেখা না থাকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খুচরা বিক্রেতারা এ বিষয়ে সচেতন হলে জাতি উপকৃত হবে। অনেক ফার্মেসির মালিকের বেখেয়ালে কোন কোন ঔষধের মেয়াদ কখন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে দেখেওনা। কিন্তু ভোক্তার জন্য এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর। পণ্য বা সেবা কেনার সময় ভোক্তারও উচিত দেখেশুনে ক্রয় করা।
আমরা ভেজাল পণ্য না কিনলে উৎপাদনকারী কোম্পানি যত বড়ই হোক একদিন পথে বসবেই। আসুন, আমরা ভোক্তার অধিকার বিষয়ে সচেতন হই, ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।