করোনার মোকালিায় দেশের মানুষ চায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন

  • আশীষ কুমার সেন

যত দিন যাচ্ছে করোনার আঘাতে মানুষ দিশেহারা। প্রায় দুই মাস হতে চলল। গত ৫ এপ্রিল থেকে এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনার আঘাত মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতটা সংবেদনশীল, তৎপর, প্রশাসন বা সরকারের অন্যরা ততটা নয়। প্রধানমন্ত্রী যত দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিচ্ছেন, বাস্তবায়নে ততটাই পিছিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়। তিনি এক পা হাঁটলে যেখানে অন্যদের দৌড়ানোর কথা, সেখানে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি একাই দৌড়াচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে করোনার ক্ষতি সামলানো প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভব হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে রংপুর বিভাগের আট জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করবেন। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারি এবং সশস্র বাহিনীর প্রতিনিধিসহ শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম এই ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত থাকবেন।

অথচ এতো চেস্টা করার পরেও প্রধানমন্ত্রীর ৩১ নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাও অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলেও দ্রব্যমূল্য রোজা সামনে রেখে বেড়ে চলেছে। পুরনো চক্রগুলো সক্রিয় রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খুলে দেওয়ার কথা বললেও কারখানাগুলোর অনেকেই তা মানছে না। অনেককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা ও তদারকির অভাব বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত

এসব প্রণোদনা দ্রুত কিভাবে সুবিধাভোগীরা পাবে সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর তৎপরতায় ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। কারা পাবে, কিভাবে পাবে, কতটুকু পাবে, ঋণখেলাপি হলে পাবে কি না, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আর প্রকৃত ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে কারা কিভাবে পাবে ইত্যাদি বিষয়ে অসংগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার জারি করলেও তার অনেক দুর্বলতায় শিগগিরই সুফল মিলবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

মানুষের জীবন বাঁচানো থেকে শুরু করে তাদের স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসার যাবতীয় খোঁজখবর যেমন তাঁকেই নিতে হচ্ছে, তেমনি পোশাককর্মীদের বেতন-ভাতা, তাঁদের ছাঁটাই না করা, ধান চাষ বাড়ানো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালু, সবার জন্য প্রণোদনা, ঋণের কিস্তি ও সুদ স্থগিত করা, দরিদ্রদের খাবার পৌঁছানো থেকে শেরপুরের ভিক্ষুকের মহানুভবতার দিকটিও নজরে রাখতে হচ্ছে তাঁকে। বেশির ভাগ এমপি, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়রসহ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সেবায় অনুপস্থিত। উল্টো কতিপয় জনপ্রতিনিধির চাল ও তেল চুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে।

এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সম্প্রতি গনমাধ্যমকে বলেন, করোনার আঘাতের পর থেকেই মন্ত্রণালয়গুলোর সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার পাশাপাশি করণীয় কর্মপরিকল্পনা জানানোর কথা। তা না হয়ে থাকলেও এখনি তা করা উচিত। এ ছাড়া অর্থ, পরিকল্পনা, ইআরডি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কিভাবে করা যায়, অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে, এবারের বাজেট কী রকম হবে এসবসহ সার্বিক একটি কর্মপরিকল্পনা ও কার কী দায়িত্ব তা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিনিয়ত অবহিত করা দরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও যেসব সার্কুলার জারি করছে, তা শীর্ষ কর্মকর্তাদের দেখে চূড়ান্ত করা দরকার। না হলে নানা অসংগতি থেকে যাবে।

করোনার আঘাতে একই সঙ্গে জীবন বাঁচানো এবং নিজের খাওয়া-পরার যুদ্ধ করছে মানুষ। দরিদ্র মানুষের সহায়তায় অর্থ, খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি সরকারি নানা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এসএমই, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ভর্তুকি দিয়ে তহবিল দিয়েছেন। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের যাতে খাবারের সমস্যা না হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। তবে তিনি সব কিছু সময়মতো দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর ত্বরিত কাজ করতে না পারায় এখনো কার্যকর সুফল নেই এসব প্রণোদনা বা ঘোষণার। এখনো সব প্রণোদনা প্যাকেজে নানা অসংগতিও ধরা পড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব প্যাকেজ তদারকি করছে, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে। তবে লকডাউনের কারণে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ সভা হচ্ছে না দুই মাস ধরে। ফলে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গতকাল দৈনিক জনতাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য তাৎক্ষণিক প্রণোদনা ঘোষণা করলেও এসবের অর্থসংস্থানও একটা বড় বিষয়। নানা নীতি সহায়তা দিয়ে এসব তহবিল জোগানোর কথা তিনি বলেছেন। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আয় কমছে। সরকারের ব্যয় বাড়ছে। রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্সও হুমকিতে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি সহায়তা লাগবে। দাতারাও চাপে আছে। কতটুকু সহায়তা পাওয়া যাবে তার ভরসা নেই। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কৌশল কী হবে তার রূপরেখা প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রীকে জানানো এবং তিনি যা বলেন, তা বাস্তবায়ন জরুরি হলেও এসব কার্যক্রমে আছে অনেক অসংগতি। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তৎপরতা সুচারুভাবে পরিচালনার নির্দেশ দিলেও শুরু থেকেই এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানদের অনেকেই উল্টো সরকারি চাল ও তেল চুরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এমন ঘটনা দেশের বিভিন্ন জেলায় ধরা পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে আমি বলবো এ সকল দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া, ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেওয়া হবে। কিন্তু সার্কুলারের অসংগতির কারণে এখনো তা সুবিধাভোগীরা পেতে শুরু করেনি। এছাড়া ব্যাংকব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বয়হীনতা আছে এ খাতেও। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে তা তো সাধারন মানুষের টাকা। এ নিয়ে তো জটিলতা হওয়ার কথা নয়। এ পরিস্থিতে আমাদের পক্ষ থেকেও একটি পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি। তিনি আরো বলেন, দেশের মানুষ চায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে তার দলীয় মানুষ গুলোকে দেশ প্রেমিক হতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *