ভিবি নিউজ-পুলিশকে নিয়ে আমরা নানা সময়ে নানা কটূক্তি করি। তাদের পেশা, দায়িত্ব, স্বভাব নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শালিনতাবোধ থাকে না আমাদের। পান থেকে চুন খসলেই তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে কার্পণ্য করি না। এটাই আমাদের চিরায়ত স্বভাব। যারা সব চেয়ে কাছে থাকেন, যারা সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন, বিপদে আপদে সবার আগে যারা ছুটে আসেন- তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবো না তো কাদের করব?
ভেবে দেখুন, এই দেশে যদি একজনও পুলিশ না থাকতো, তাহলে দেশের চিত্রটা কেমন হতো? কোনো সড়কই যানবাহন চলার উপযোগী থাকতো না। পিঁপড়ার মতো মানুষ মরতো প্রতিনিয়ত। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যা, গুম, ধর্ষণ হতো স্বাভাবিক ঘটনা।
চোরা কারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মে স্বাভাবিক ব্যবসা বাণিজ্য ব্যহত হতো। হাসপাতালে, খেলার মাঠে, পাসপোর্ট অফিসে, বিআইটিতে, স্টেশনে, বন্দরে মানুষ নিজেরাই নিজেদের সাখে সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। প্রাকৃতিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগে মানুষ অসহায় হয়ে পড়তো। কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাবলীলভাবে অনুষ্ঠিত হতো না। প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে, শহরে, হাটে, বাজারে, অফিসে, আদালতে সর্বক্ষণ অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করতো। দেশের প্রতিটি মানুষ থাকতো অনিরাপদ, উদভ্রান্ত। সর্বোপরি পুরো দেশটাই বিশৃঙ্খলার জালে জড়িয়ে থাকতো।
বাংলাদেশের প্রায় ২ লক্ষাধিক পুলিশ সদস্য নিজেদের সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে দেশের মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার কাজে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত দেশের নানা দুর্যোগ, দুঃসময় মোকাবেলায় পুলিশের অবদান সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে তারা দেশের সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাচ্ছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রিড়া ক্ষেত্রেও তাদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান।
করোনার এই সংকটকালে পুলিশের শ্রম, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও দায়িত্বশীলতা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে তারাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন। শহর থেকে দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনসমাগম রোধ, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণ, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখা, লকডাউলকৃত এলাকার মানুষকে অবরুদ্ধ রাখা, বাজার সদাই করে দেওয়া, রোগীকে হাসপাতালে আনা-নেয়াসহ মানুষকে ঘরে রাখার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন পুলিশ সদস্যরা।
এছাড়াও, করোনা চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি করোনায় মৃতদের সমাহিত বা সৎকার করার দায়িত্বেও পিছপা হচ্ছেন না তারা। বাড়িতে চিকিৎসারত করোনা রোগীদের নিরাপত্তা ও সেবা দানেও তারা বদ্ধ পরিকর।
পুলিশরাও মানুষ। তাদেরও পরিবার আছে। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন তাদেরও আছে। বাবা-মাকে দেখতে, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে, সন্তানকে আদর করতে তাদেরও ইচ্ছে করে। তাদেরও ইচ্ছে করে, পরিবারের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খেতে, মেয়ের সাথে লুডু খেলতে, ছেলের সাথে গল্প করতে। অসুস্থ বাবা মায়ের ওষুধের কৌটা এগিয়ে দিতে, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে, নিজের ছোট্ট শিশু সন্তানটির কপালে একটি চুম্বন এঁকে দিতে তাদেরও খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু, তারা সেটা পারছেন না। দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে তারা নিজেদের সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস, প্রেম- ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছেন।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৭ জন। ঠিক মতো পাচ্ছেন না নিরাপত্তা সামগ্রী। দেশের ৬৩টি জেলাই এখন করোনা অাক্রান্ত। তবু তারা পিছপা হচ্ছেন না। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দায়িত্বরত সকল পুলিশ সদস্যকে শতভাগ নিরাপদ পিপিই, আর্থিক ও পেশাগত প্রণোদনা দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
পুলিশরা আমাদেরই স্বজন। এদেশের নাগরিক। বাঁচার অধিকার তাদেরও আছে। দেশের সকল নাগরিকের মতো তারাও নিরাপদে ঘরে বসে থাকতে পারতেন। টেলিভিশন, সিনেমা আর ফেইসবুক দেখে শুয়ে-বসে কাটাতে পারতেন সময়টা। মা-বাবার স্নেহ, স্বামী-স্ত্রীর আদর, সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে তারাও মধুময় করতে পারতেন এই অবারিত অবসরটাকে। কিন্তু, তারা তা করেন নি। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে তারা এখন ব্রতী। সকল মানুষ যখন ঘরে, তারা তখন বাইরে। হ্যাঁ, আমাদের জন্যই তারা রোদে পুড়ছেন, বৃষ্টিতে ভিজছেন, ধূলাবালি খাচ্ছেন, নির্ঘুম থাকছেন, ১০ থেকে ১৮ ঘণ্টা ডিউটি করছেন। এমন নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলো আছেন বলেই, আমরা এখনো ভালো আছি। আপনাদেরকে স্যালুট, বাংলাদেশ পুলিশ।
লেখক: কবি
মমিরুল মোমেন