স্টাফ রিপোর্টার
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দেশে এলাকাভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে লকডাউন ঘোষণার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা ও ঝুঁকি বিবেচনায় তিন ভাগে ভাগ করে ( রেড জোন, ইয়েলো জোন ও গ্রিন জোন) ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লকডাউনের চিন্তা করছে সরকার। করোনার আপডেট সংক্রান্ত সরকারি ওয়েবসাইটে দেশের তিনটি বিভাগের ৫০টি জেলা ও ৪০০টি উপজেলাকে পুরোপুরি লকডাউনের তালিকায় ( রেড জোন বিবেচিত) দেখানো হয়েছে। আংশিক লকডাউন (ইয়েলো জোন বিবেচিত) দেখানো হয়েছে পাঁচটি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর লকডাউন নয় (গ্রিন জোন বিবেচিত) এমন জেলা দেখানো হচ্ছে একটি এবং উপজেলা দেখানো হচ্ছে ৭৫টি। তবে সরকারি ওয়েবসাইটে তালিকা দেয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি। সরকারি ওয়েবসাইটে দেয়া তালিকায় বরিশাল বিভাগের মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন দেখানো হয়েছে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরকে। এই বিভাগে আংশিক লকডাউন ভোলা ও ঝালকাঠি।
এদিকে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে জোনভিত্তিক (রেড, ইয়েলো এবং সবুজ) লকডাউন ঘোষণার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছে। সম্মতি পেলেই জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম শুরু করবে সরকার। রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় যে দুটি এলাকাকে পরীক্ষামূলক লকডাউন করার আলোচনা চলছে, সেটিও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতোমধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তুত করে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। যা গতকাল রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর কথা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রএসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল দৈনিক জনতাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরেই জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর আগে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে সরকার। তিনি জানিয়েছেন, আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রধানদের সমন্বয়ে একাধিক সভা করেছি। সেই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাংশ তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য পাঠিয়েছি। আমাদের তৈরি করা সারাংশতে উলি্লখিত প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তগুলো যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা সেটি বাস্তবায়ন করবো। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, পরীক্ষামূলক বলেন আর চূড়ান্ত বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরেই তা বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি এখনও কিছু জানি না। আমি আগে জেনে নেই, তার পরে আপনাকে জানাবো। এদিকে সারাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে রেড, ইয়েলো এবং গ্রিনজোনে চিহ্নিত করে নতুনভাবে লকডাউন শুরু করার বিষয়ে শুক্রবার এক অনলাইন কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এমন অভিমত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, দেশের একটি এলাকায় যদি ১ লাখ মানুষ বসবাস করে আর সেখানে যদি ১৮ থেকে ২০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে থাকে তবে সেই এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে বলে জানা গেছে। কেউ কেউ বলেছেন, প্রতি লাখে ১৮ থেকে ২০ নয়, ৩০ থেকে ৪০ বা তার ওপরে হলে সেইসব এলাকাকে রেড জোনে শনাক্ত করা হতে পারে। এ বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপক্ষোয় রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্র। সূত্র জানায়, এটা ওয়ার্ডভিত্তিকও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে যাদের ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত করা হয়েছে তাদের এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হবে। যেসব এলাকায় কম চিহ্নিত রোগী থাকবে সেসব এলাকাকে ইয়েলো জোন ও যেসব এলাকায় সংক্রমণ পাওয়া যাবে না সেসব এলাকাকে গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ইয়েলো জোন ও গ্রিন জোনের কর্মকা- কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এই জোনের আওতায় থাকা এলাকাগুলোকে রাখা হবে নজরদারিতে। যাতে এসব এলাকা থেকে কেউ রেড জোনে প্রবেশ করতে না পারে। একই সঙ্গে রেড জোনের কেউ যাতে ইয়েলো বা গ্রিন জোন এলাকায় আসতে না পারে সেজন্য নিশ্চিত করা হবে কঠোর লকডাউন। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান জানিয়েছেন, জোনভিত্তিক এলাকায় নিরাপত্তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে স্থানীয় প্রশাসন কঠোর হয়ে ব্যবস্থা নেবে। এদিকে আইসিটি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত রোগীদের চিহ্নিত করা হবে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে। এর জন্য বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। সেটি ব্যবহার করে সকল এলাকায় এখন পর্যন্ত যত রোগী শনাক্ত হয়েছে তাদের একটা ম্যাপিং করা হবে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে এই ম্যাপিংয়ের কাজ শেষ করা হয়েছে। এরপরেই নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকাও এখন চিহ্নিত করার কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞরা এগুলো নিয়ে কাজ করছেন। সবকিছু শেষ করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে তা বাস্তবায়ন হবে বলে জানিয়েছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।
রাজধানীর যে এলাকাগুলো ইয়েলো ও গ্রিন জোনের আওতায়: রাজধানী ঢাকায় সর্বাধিক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে রাজধানী ঢাকার কোনো থানাকে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। তবে ৩৮টি থানাকে আংশিক লকডাউন ঘোষণা বা ইয়েলো জোনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ১১টি থানাকে লকডাউন নয় বা গ্রিন জোনে দেখানো হয়েছে। গতকাল রোববার করোনা ইনফো ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। রাজধানীর ইয়েলো জোন: আদাবর, থানা, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, ওয়ারী, কদমতলী, কলাবাগান, কাফরুল, কামরাঙ্গীরচর, কোতোয়ালি, খিলক্ষেত, গুলশান, গে-ারিয়া, চকবাজার, ডেমরা, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, দক্ষিণখান, দারুসসালাম, ধানম-ি, নিউমার্কেট, পল্টন মডেল, পল্লবী, বংশাল, বাড্ডা, বিমানবন্দর, ভাটারা, মিরপুর মডেল, মুগদা, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রমনা মডেল, লালবাগ, শাহআলী, শাহজাহানপুর, শেরে বাংলানগর, সবুজবাগ, সূত্রাপুর ও হাজারীবাগ থানা এলাকা। গ্রিন জোন: উত্তরখান থানা, ক্যান্টনমেন্ট থানা, খিলগাঁও, তুরাগ, বনানী, ভাষানটেক, মতিঝিল, রামপুরা, রূপনগর, শাহবাগ ও শ্যামপুর থানা এলাকা।
রেড জোনের আওতায় দেশের অর্ধশত জেলা: গতকাল রোববার সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওয়েবসাইট ( করোনা ইনফো ) থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে দেশের তিনটি বিভাগসহ ৫০টি জেলা ও ৪০০ উপজেলাকে রেড জোন বা পুরোপুরি লকডাউন দেখানো হচ্ছে। ইয়েলো জোন বা আংশিক লকডাউন দেখানো হচ্ছে পাঁচটি বিভাগ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে। আর গ্রিন জোন বা লকডাউন নয়, দেখানো হচ্ছে একটি জেলা এবং ৭৫টি উপজেলাকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে: এ বিভাগের গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও টাঙ্গাইলকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগে শুধু ঢাকা ও ফরিদপুরকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগে: এ বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কঙ্বাজার, ফেনী, খাগড়াছড়ি, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটিকে আংশিক লকডাউন বলা হয়েছে। সিলেট বিভাগে: এ বিভাগের সব জেলা অর্থাৎ- হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেটকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। ময়মনসিংহ বিভাগে: এ বিভাগের সবকটি জেলাকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ জেলাগুলো হলো- জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও শেরপুর। বরিশাল বিভাগে: এ বিভাগের মধ্যে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। বরিশাল বিভাগের ভোলা ও ঝালকাঠিকে আংশিক লকডাউন বলা হয়েছে। খুলনা বিভাগে: এ বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, নড়াইল ও সাতক্ষীরাকে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের বাগেরহাট, কুষ্টিয়া ও মাগুরাকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে। খুলনা বিভাগেই দেশের একমাত্র গ্রিন জোন বা বা লকডাউন নয় এমন হিসেবে ঝিনাইদহকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রংপুর বিভাগে: এ বিভাগের সব জেলাকেই পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। জেলাগুলো হলো- দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও। রাজশাহী বিভাগে: এ বিভাগের বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীকে মধ্যে পুরোপুরি লকডাউন বলা হচ্ছে। এ বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জকে আংশিক লকডাউন বলা হচ্ছে।