স্টাফ রিপোর্টার
মহামারী করোনাভাইরাস দ্বিতীয় ধাপ মোকাবিলায় ১৮ দফা জরুরি নির্দেশনা সরকার জারি করার পর গতকাল মঙ্গলবার থেকে ১৮ দফা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৮ দফা জরুরি নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়াও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ করায় গণপরিবহণে ৬০ ভাগ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ বুধবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এবং পরবর্তী দুই সপ্তাহ তা বহাল থাকবে। তবে গতকাল মঙ্গলবার থেকেই ঢাকা থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন জেলায় বাস ও ট্রেন ছেড়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবারও ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৮ হাজার ৯৯৪ জন। একই সময়ে করোনা শনাক্তে ২৬ হাজার ৬২০টি নমুনা পরীক্ষায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪২ জন। এ নিয়ে শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৬ লাখ ৫ হাজার ৯৩৭ জন।
জানা গেছে, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চ সংক্রমণ যুক্ত এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক, রাজনৈতিক, ও ধর্মীয় অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক না পরলে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসব নির্দেশনা অনতিবিলম্বে সারাদেশে কার্যকর হবে এবং আপাতত অন্তত দুই সপ্তাহ বলবৎ থাকবে। দেড় ডজন নির্দেশনায় আরো যা আছে তা হলো-ক. সব ধরনের জনসমাগম (সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/অন্যান্য) সীমিত করতে হবে। উচ্চ সংক্রমণের এলাকায় সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকবে। বিয়ে/জন্মদিনসহ যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হবে। খ. মসজিদসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। গ. পর্যটন/বিনোদন কেন্দ্র/সিনেমা
হল/থিয়েটার হলে জনসমাগম সীমিত করতে হবে এবং সব ধরনের মেলা আয়োজন নিরুৎসাহিত করতে হবে। ঘ. গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহণ করা যাবে না। ঙ. সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে; প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে। চ. বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক ( হোটেলে নিজ খরচে) কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। ছ. নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য খোলা/উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচার ব্যবস্থা করতে হবে, ওষুধের দোকানেও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। জ. স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাস্ক পরাসহ যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। ঝ. শপিং মলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইর যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। ঞ. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদ্রাসা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়) ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। ট. অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা/আড্ডা বন্ধ করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাত ১০টার পর বাইরে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঠ. প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক না পরলে কিংবা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ড. করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যদেরও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে। ঢ. জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস/প্রতিষ্ঠান/ শিল্প কারখানায় পরিচালনা করতে হবে অর্ধেক জনবল দিয়ে। গর্ভবতী/ অসুস্থ/ ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ণ. সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ কর্মশালা যথাসম্ভব অনলাইনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ত. সশরীরে উপস্থিত হতে হয়- এমন যে কোনো ধরনের গণপরীক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। থ. হোটেল- রেঁস্তোরায় ৫০ শতাংশ আসনের বেশি মানুষ বসানো যাবে না। দ. কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে গত বছরের ৮ মার্চ। এর ১০ দিন পর প্রথম মৃত্যু হয়। সমপ্রতি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। এমতাবস্থায় এসব নির্দেশনা জারি করল সরকার।
গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত সোমবার দেশে ৪৫ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওইদিন শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ১৮১ জন রোগী। যা বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ। গতকাল মঙ্গলবারও ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে করোনা শনাক্তে ২৬ হাজার ৬২০টি নমুনা পরীক্ষায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪২ জন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশের ২২৪টি সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে ২৭ হাজার ৩৫০টি নমুনা সংগ্রহ ও ২৬ হাজার ৬২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার ৬৪৫টি।
গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শনাক্তের মোট হার ১৩ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। একই সময়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন দুই হাজার ১৬২ জন। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ১৮০ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত ৪৫ জনের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছরের একজন, বিশোর্ধ্ব দুইজন, ত্রিশোর্ধ্ব দুইজন, চলি্লশোর্ধ্ব সাতজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব আটজন ও ষাটর্োর্ধ্ব ২৫ জন রয়েছেন।
একই সময়ে বিভাগওয়ারী দেখা গেছে, মৃত ৪৫ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩৭ জন, চট্টগ্রামে তিনজন, রাজশাহীতে দুইজন, খুলনায় দুইজন এবং সিলেট বিভাগে একজনের মৃত্যু হয়।
অপরদিকে, গতকাল মঙ্গলবার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবনে ব্রিফিংকালে বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বুধবার থেকে দেশের সকল গণপরিবহণে অর্ধেক যাত্রী নেয়া সাপেক্ষে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এ আদেশ বহাল থাকবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভাড়া পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। এর আগে গত সোমবার গণপরিবহণে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহণের নির্দেশনা জারি করে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে করোনা প্রতিরোধে মোট ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। সেখানে এ কথা বলা হয়।
সরকারের এমন নির্দেশনার পর ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানতে পেরেছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ নিয়ে বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়নি। এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে গত বছরের মতো নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়াতে হবে। গত সোমবারের ওই নির্দেশনায় আরো বলা হয়, সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাতে আন্তঃজেলা যান চলাচল সীমিত করতে হবে। প্রয়োজনে বন্ধ রাখতে হবে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক (হোটেলে নিজ খরচে) কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, করোনা সংক্রমণ রোধে ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহণ শুরু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পাশাপাশি দুটি আসনের একটি ফাঁকা রাখা হয়েছে। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, গত ৪ মার্চ থেকে আমরা টিকিট বিক্রিতে কিছুটা পরিবর্তন আনি। আর সেটা হচ্ছে আগে ১০ দিন আগ থেকে টিকিট পাওয়া যেতো। ওই দিন থেকে আমরা পাঁচ দিন আগের টিকিট বিক্রি করেছি। আর গত সোমবার থেকে যেসব ট্রেনের ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে সেগুলোর টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়। আর যেগুলোর ৫০ শতাংশ বিক্রি হয়নি, সেগুলোর ৫০ শতাংশ বিক্রি হওয়া পর্যন্ত বিক্রি করা হয়।
সাহাদাত আলী আরো বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল কার্যকর হয়েছে। তখন থেকেই আমরা কম্পিউটারে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা বলে দিয়েছি ৫০ শতাংশের ওপরে কোনো টিকিট বিক্রি হবে না। যেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে, তা তো হয়েই গেছে। তবে ট্রেনে অর্ধেক সিট ফাঁকা রেখে চালানো হবে। moonrock gummies
বাংলাদেশ রেলওয়ের অপারেশন শাখা থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, এখন থেকে এক আসন ফাঁকা রেখে ট্রেন চলবে। প্রতিটি ট্রেনের মোট টিকিটের অর্ধেক বিক্রি করা হবে। এর মধ্যে ২৫ ভাগ টিকিট কাউন্টারে এবং ২৫ ভাগ অনলাইনে থাকবে।